কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা
চূড়ান্তর রায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামি এখনো পলাতক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ:
০৩
নভেম্বর
২০২২ ,
বৃহস্পতিবার
১১ : ১১ এএম প্রদর্শিত হয়েছে ৮০৪৪ বার
|
আজ ৩ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালের এই দিনে রচিত হয়েছিলো ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে সেদিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাই জঘণ্যতম হত্যাকাণ্ডের এই দিনটিকে পালন করা হয় জেল হত্যা দিবস হিসেবে। নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর ওই সময়ের কারা উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজন) আবদুল আউয়াল লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করা হয়। মামার এজাহারে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সেনা সদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করেন। গুলি করে নেতাদের হত্যা করা হয়। পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা দায়েরের ২৩ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মো. মতিউর রহমান মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন (পলাতক), দফাদার মারফত আলী শাহ (পলাতক) ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধাকে (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চার আসামি সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদসহ ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত। আর সাবেক মন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে দেয়া হয় খালাস । বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট মোসলেমের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি মারফত আলী ও হাশেম মৃধাকে খালাস দেন। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ফারুক, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকেও খালাস দেয় হাইকোর্ট। তবে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। এরা হলেন কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), মেজর (অব.) এ কে বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলে ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে বিচারিক আদালতের রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির আপিল বেঞ্চ রায় দেয়। প্রধান বিচারপতি ছাড়াও বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি মো. আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. ইমান আলী ছিলেন। সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন হলেন রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার আবুল হাশেম মৃধা। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আবদুল মাজেদ, আহমদ শরিফুল হোসেন, মো. কিসমত হোসেন, নাজমুল হোসেন আনসার, সৈয়দ ফারুক রহমান, শাহরিয়ার রশিদ, বজলুল হুদা ও এ কে এম মহিউদ্দিন। তবে জেলহত্যা মামলার ১০ আসামি এখনও পলাতক। তারা হলেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মোসলেম উদ্দিন, আপিল বিভাগের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মারফত আলী শাহ ও আবুল হাসেম মৃধা, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আহমদ শরিফুল হোসেন, কিসমত হোসেন ও নাজমুল হোসেন আনসার। এদিকে গত বছর পলাতক আসামি আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া পলাতক অবস্থায় খুনিদের একজন আবদুল আজিজ পাশা ২০০১ সালের ২ জুন জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন বলে জানা যায়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জেল হত্যা মামলার আসামি সাবেক হাইকমিশনার খায়রুজ্জামানকে মালয়েশিয়ায় আটক করা হয়েছে। সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা ২০০৪ সালে জেল হত্যা মামলা থেকে খালাস পান। ২০০৫ সালে তিনি মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়োগ পান৷ পরে ২০০৭ সালের আগস্টে তাকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর খায়রুজ্জামানকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি সেই নির্দেশ অমান্য করে মালয়েশিয়ায় থেকে যান। সরকারের বিভিন্ন সূত্র জানায়, জেলহত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী কানাডা এবং লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরে চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে এক অনুষ্ঠানে বলেন, খুনি রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করা হয়েছে। এদিকে কানাডার হাইকমিশনার লিলি নিকোলস গত মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাতে নূর চৌধুরীকে ফেরত পাঠানোর জন্য বিকল্প পথ খুঁজতে কানাডার প্রতি অনুরোধ জানান আইনমন্ত্রী। এ ব্যাপারে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘ইতিহাসের জঘন্যতম জেল হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায় হযেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে। তবে এখনো দণ্ডপ্রাপ্ত অনেক আসামি পলাতক আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে অবশ্যই দণ্ড কার্যকর করা হবে।’ ইতিহাসের প্রেক্ষপট তুলে ধনে আনিসুল হক বলেন, ‘খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভার সব সদস্যই ছিলেন হত্যাকারীদের সঙ্গে হাত মেলানো আওয়ামী লীগার এবং এটা ছিল একটা আধা-সামরিক সরকার। অভ্যুত্থানকারী মেজর-ক্যাপ্টেনরাই ওই সরকারের ওপর ছড়ি ঘোরাত। ওই সরকারের পেছনে সেনা সমর্থন থাকলেও, বঙ্গভবনের ওপর তাদের পুরোপুরি কর্তৃত্ব ছিল না। ২৪ আগস্ট তখনকার সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহকে সরিয়ে জিয়াউর রহমানকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। এই জিয়াই পরবর্তীতে জেলহত্যা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের পৃষ্ঠপশোকতা করেছিলেন এবং অনেককে দেশের আইরে পারিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করেছিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘জেল হত্যা মামলার সর্বোচ্চ আদালতের রায় হয়েছে। তবে এখনো অনেক আসামিই পলাতক। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্করা করলে দেশ আরো একবার কলঙ্কমুক্ত হবে।’ |
« পূর্ববর্তী সংবাদ | পরবর্তী সংবাদ » |
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ অঞ্জন কর
প্রকাশকঃ জেরীফ আফতাব কর্তৃক
জেড টাওয়ার (৬ষ্ট তলা), বাড়ী- ০৪, রোড-১৩২, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২ থেকে প্রকাশিত
ইমেইলঃ tribunenewsbd@gmail.com
© 2022 সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত || tribunenewsbd.com